যদি প্রশ্ন রাখা হয়, ছাত্ররাজনীতির নামে শিক্ষাঙ্গনে আজ যে অরাজকতা, আধুনিকতার মুখোশে উঠতি ‘রোমিও’দের যে বখাটেপনা, জনসেবা ও দেশপ্রেমের বুলি
আউড়ে যে অবাধ দুর্নীতি ও টেন্ডারবাজি, অগ্রচিন্তার যবনিকায়
যে বিবেক-বিধ্বংসী জুয়ার আড্ডা বা সুন্দরী-প্রতিযোগীতার অন্তরালে যে বেলেল্লাপনা, অর্থনীতির
ছদ্মবেশে লুন্ঠন ও কুসীদের যে জয়যাত্রা, গনতন্ত্রের আড়ালে যে প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার উপযোগীতা,
নারীমুক্তি ও শিল্পকলার মোড়কে যে অবাধ লাম্পট্যের জোয়ার- এর উৎসমূল কোথায়? সর্বস্তরের নাগরিকই একবাক্যে শিকার করবেন এ
বিষবৃক্ষের কান্ডমূল হচ্ছে “অসুস্থ শিক্ষানীতি”।
যাকে বাল্যকালে ‘দুধের সাথে পানি মিশানোর’ অংক শিক্ষা দেওয়া হয়, বড়
হয়ে তার চর্চিত ভেজাল কার্যক্রমকে হাজারো “মোবাইল কোর্ট” দিয়েও কি দমন করা সম্ভব? যে শিশুকে ‘সুদ-কষা’র গনিতের মাধ্যমে সুদ একটি হালাল ও লাভজনক বস্তু হিসেবে
দীক্ষা দেওয়া হচ্ছে, তার সুদ-ঘুষ আশ্রিত
ভবিষ্যতকে সহস্র “দুদক”এর বুলডোজার দিয়েও
কি বদলানো যাবে?”লেখাপড়া করে যেই, গাড়ি ঘোড়া চড়ে সেই”-এই দিয়ে যাদের
শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি,তাঁদের ব্যসন-বিলাসিতার পাহাড়সম লক্ষ্যকে দেশপ্রেমের ঠুনকো
টোকায় হটানো কি সম্ভব? যেসব শিক্ষানবিশরা ‘ডারউইন’এর “বানর মনমানসিকতা”য় বেড়ে
উঠবে তাদের কাছ থেকে পশুবৃত্তি ছাড়া অন্যকিছু আশা করা কি অলীক-কল্পনা নয়? যে
প্রজন্মকে ‘ফ্রয়েড’এর “যৌন মতবাদ” বা ‘মারক্স’এর “বস্তুবাদ” গিলানো হয় সে
প্রজন্মকে মনুষ্যরূপি সারমেয় কিংবা অন্ধকারের গন্ধমূষিক ছাড়া আর কিইবা বলা যেতে
পারে?এদের সম্বন্ধে এ আয়াতটিই যথার্থঃ
[1]
(ويتعلمون ما يضرهم
ولا ينفعهم. ولقد علموا لمنشتراه ما له في الآخرة من خلاق. ولبئس ما شروا به
أنفسهم لو كانوا يعلمون)
তাই এরকম “শিক্ষানীতি”র নির্যাসে পুষ্ট পাশ্চাত্যের অক্সফোর্ড-কেম্ব্রিজ-হার্ভার্ড
আমাদেরকে কাম-কাতর ক্লিনটন,মানবরক্তপিপাসু বুশ, কিংবা কুহক-ফেরীওয়ালা
সালমান রুশদী আর দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জ্ঞানপাপী হুমায়ুন আজাদ কিংবা রিরংসু তাসলিমা
নাসরিনের মত আত্মবিক্রীত কিছু ক্রীতদাসই উপহার দিয়েছে এবং দিয়ে
যাচ্ছে।
এ জাতীয় নীতিহীন শিক্ষানীতির কল্যাণে আজ
দেশ পাচ্ছে অজস্র “বৃদ্ধাশ্রম”।বেঙের
ছাতার মতো গজাচ্ছে “মাদক-পুনর্বাসন কেন্দ্র”।জমে উঠছে
চাইল্ড/ডে-কেয়ারের জমজমাট ব্যবসা।“নাইটক্লাব” ও “পতিতালয়” নামের লা’নতের গুদাম।শতকোটি আলোকবর্ষ দূরের নক্ষত্র নিয়ে তার চিন্তার অন্ত নেয় অথচ
তার সন্তান যে কুখ্যাত দস্যু হচ্ছে তার খেয়াল নেয়।বিশ্বনারীমুক্তি আন্দোলনের নেতার
আপন স্ত্রী যে অবজ্ঞায় অবহেলায় বিকারগ্রস্থ তা কে বলবে।এবং এইজন্যই বুভুক্ষু মানুষের
সামনে গড়ে উঠে কুকুর-বিড়ালের জন্য সুসজ্জিত “ম্যাকডোনাল্ড” রেস্টুরেন্ট।শিক্ষিত মাফিয়া-ডনদের অবদানে চলে মাদক ও অস্ত্র ব্যবসা।
পরিকল্পিত এই শিক্ষানীতির বীজ কিন্তু বপন
করেছিলো আমাদের এককালের সাম্রাজ্যবাদী শাসক ইংরেজরাই।এ বিষবৃক্ষ রোপণকালে ‘লর্ড
মেকলে’ বলেছিলেন “ They will be Indian in blood and colour but English in taste,
in opinion, in intellect.”[2]
বাস্তবেও হয়েছে তাই, ইংরেজদের কাছ থেকে ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জিত হলেও আমরা মুক্ত
হতে পারিনি তাঁদের ‘শিক্ষাপদ্ধতি’ নামক অক্টোপাসের নাগপাশ থেকে।ফলে আমাদের
প্রজন্মের দেহক্ষেত্রে অঙ্কুরোদিত হয়েছে তাদেরই চিন্তা-চেতনা,মতবাদ-ভাবধারা, আর
মন-মগজে শক্তভাবে শিকড় গেড়েছে বস্তুবাদী ডিনামাইট সমৃদ্ধ নাস্তিক্যবাদী বিশ্বাসের
হলাহল।
হিজরি সপ্তম শতকে মুস্লিম সাম্রাজ্যে তাতারীদের সামরিক
বিজয় পঞ্চাশ-ষাট বছরও টিকেনি, মুসলমানদের উন্নত শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি
ও ধর্মীয় ভাবধারার কাছে তাঁদের বশ্যতা স্বীকার করতে হয় অচিরেই।কিন্তু আজ থেকে
পঞ্চাশ বছর আগে বাংলার মুসলমানরা যে সামরিক ও রাজনৈতিক জয় অর্জন করে তার ভিতর
দিয়েই তাঁদের শিক্ষা-সভ্যতা ও সংস্কৃতির ভিত ধ্বসে পড়ে।ইংরেজদের মতবাদ ও ভাবধারার
দাসত্ব গ্রহন করে।
তারা এখন নেই,কিন্তু তাঁদের প্রেতাত্মারা আজো
বিরাজ করছে আমদের মধ্যে,আমরা আজও ইংরেজের চোখ দিয়ে জগত ও জীবঙ্কে দেখছি,ওদের মগজ
দিয়ে ওগুলোকে বুঝতে ও জীবনের আচরণকে স্থির করতে চেষ্টা করছি।এর চেয়ে দুঃখের বিষয়
আর কী হতে পারে!
পরবর্তী ধাপে ইংরেজরা মুসলমানদের ইসলাম সম্পরকে
বিমুখ ও উদাসীন করে তোলার উদ্দেশ্যে “এনজিও” ও “প্রাচ্যবিদ” ও “মিডিয়া”র মাধ্যমে
ইসলামী আচার-অনুষ্ঠান ও বিধান-ব্যবস্থাকে ঠাট্টা বিদ্রুপের লক্ষ্যবস্তুতে পরিনত
করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁদের সৃষ্ট বিপুল সংখ্যক জ্ঞানপাপীদের
অনুপ্রবেশ করিয়ে দেয়।
এ শিক্ষানীতির বিষ-ইন্ধনে লালিত-পালিত এ জ্ঞানপাপীরাই আজ “নামাজ”কে বিলুপ্ত করতে “মেডিটেশন”এর প্রচলন করছে।মানুষের “ঈমান”কে দুর্বল করার নিমিত্তে বাজারজাত করছে “কোয়ান্টাম মেথড”।ইসলামের
যাকাত ব্যবস্থাকে নির্মূল করতে গঠন করছে নানাবিধ তহবিল। “রোজা”র মত বিধানকে হেয় করছে ‘হিমু
দিবস’, ‘উপবাস দিবস’এর ফানুস উড়িয়ে। হজের গুরুগাম্ভীর্যকে ধ্বংস করছে রংবেরঙের
পর্যটনকেন্দ্রের মরীচিকা আর হানিমুন-ভ্রমন প্যাকেজের পসরা সাজিয়ে আর ‘প্রাকৃতিক
সপ্তাশ্চর্য’ প্রতিযোগীতা দিয়ে।‘শিখা অনির্বাণ’ কিংবা ‘নিরবতা পালন’ অথবা ‘গুড মর্নিং’ কিংবা ‘বাউল/লালন
সঙ্গীতে’র মতো আরো কতো প্রোপাগান্ডা যে করে যাচ্ছে
তার ইয়ত্তা নেই।এখন আবার (ধর্ম যার যার উৎসব সবার) বুলি আউড়ে যাচ্ছে
তাঁদের মুখপাত্ররা।মঙ্গলযাত্রা,থার্টিফার্স্ট নাইট,রাখিবন্ধনের মূল উদ্দীপক যে
অপশিক্ষা তা কোন আক্কেলদাঁত ওয়ালাকে বলে দিতে হয়না।
পশ্চিমের যে শিক্ষাব্যবস্থার নকলনবিসী আমরা করে
যাচ্ছি আজ সেই পশ্চিমেরই কী দুরবস্থা!এ শিক্ষাব্যবস্থা সেখানে শুধু ধবংসই ডেকে
আনছে,১৯৭৮ সালের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে “আমেরিকার মাধ্যমিক স্কুলগুলোয় প্রতি মাসে
৩০ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রী অপরাধমূলক কার্যকলাপ করে।একই পরিমান শিক্ষার্থী মারপিট ও
সংঘর্ষে হতাহত হয়...”।[3] আজ
আমরা আমাদের দেশের কলেজ-ভারসিটিগুলোতে ঠিক তার প্রতিচ্ছবিই দেখতে পাচ্ছি।সমসাময়িক
সঙ্ঘটিত “বিশ্বজিত ট্র্যাজেডি” তার জলন্ত উদাহরণ। সাম্প্রতিক
সময়ে ভারতে মেডিকেল ছাত্রীর ধর্ষিতা হয়ার মতো মারাত্মক ঘটনা কিংবা অধুনা এমেরিকায় স্কুলে
ঘটে যাওয়া শিশুহত্যার মতো ভয়ংকর ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি এ বাংলাতে ঘটার আগেই
সিদ্ধান্ত নেয়া শাশ্বত বাস্তবতা।
কিন্তু পরিত্রাণ কোথায়?এর উত্তরন
কিভাবে সম্ভব? নিঃসন্দেহে একটি নিখুত ও অনুপম শিক্ষানীতিই পারে একটি আদর্শ
জাতি গঠন করতে, যে শিক্ষানীতি বিশ্বকে উপহার দিয়েছিলো আবু বকর (রাঃ)এর মতো বিজ্ঞ সুশাসক,উমার
ও ওমর বিন আব্দুল আযীয(রাঃ)এর মতো ন্যায় বিচারক ও রাষ্ট্র-পরিচালক,খালিদ বিন
ওয়ালিদ ও সা’দ বিন আবি ওয়াককাস(রাঃ)এর মতো বীর সিপাহসালার ও সমরকুশলী,ফাতিমা
কি আয়েশা (রাঃ)এর মতো পূতঃ পবিত্র মহীয়সী নারী।তারিক বিন যিয়াদ ও
মুহাম্মদ কাসিমের মতো দিগ্বিজয়ী সিপাহসালার,হানাফী মাযহাব ও বাগদাদ নগরীর
পরিকল্পনাবিদ ইমাম আবু হানিফা প্রমুখ।
মানুষের স্বকপোলকল্পিত যে
শিক্ষানীতি তার স্বাভাবিক পরিনাম ও অবধারিত পরিনতি হচ্ছে পুনঃপুনঃ
পরিমার্জন,বারংবার পরিবর্ধন ও অশ্বডিম্ব সদৃশ বায়বীয় ফলাফল। তাই যিনি
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমগ্র মানবের রক্ষক ও পর্যবেক্ষকই শুধু নন,
শিক্ষকও বটে...সেই মহান রব্বুল আলামীনের সুনির্ধারিত সুনিপুন শিক্ষানীতিই হতে পারে মানবসন্তানের
জন্য যথোপযুক্ত ও অবিসাংবাদিত শিক্ষানীতি।মানব্-জাতির
প্রতি যাঁর প্রথম বাণীই ছিলো শিক্ষা সম্বলিত-
[4]
( إقرأ باسم ربك الذي خلق. خلق
الإنسان من علق. إقرأ وربك الأكرم. الذي علم بالقلم. علم الإنسان ما لم يعلم)
আল্লাহপাক
এখানে পরিস্কার জানিয়ে দিয়েছেন যে, অর্জিত জ্ঞান সেটা যাই হোক তা যেন হয় আল্লাহর
নিমিত্তে,আর সেই জ্ঞানে আত্মম্ভরিতার কোন অবকাশ নেই, বরং তার চর্চিত সেই জ্ঞান
মহান প্রভুর অনুগ্রহ বয় কিছু নয়।এটাই তাওহীদি শিক্ষার প্রধান মূলনীতি।
প্রথমেই মনে রাখা আবশ্যক যে, তাওহীদি
শিক্ষাব্যবস্থা বা ইসলামী শিক্ষানীতির সঙ্গে কারো কোন ব্যক্তিস্বার্থ জড়িত নয়; এর
মধ্য দিয়ে কারো কোন মতলব হাসিলেরও অবকাশ নেই। এই শিক্ষাব্যবস্থা ব্যক্তি ও সমাজের সর্বোচ্চ
উৎকর্ষের জন্যই
প্রয়োজন।কারন যিনি সমগ্র বিশ্ব-মানব-সম্প্রদায়ের অনুপম শিক্ষক, যিনি তার রাসূল্
(সঃ)কে প্রেরনই করেছেন সার্বজনীন শিক্ষকরূপে,আর তাই তাঁদের কর্তৃক প্রদর্শিত
যে-শিক্ষা, সেটার বাস্তবায়ন আদর্শধন্য তাওহিদী উম্মাহর জন্য ফরজে আইন।আদর্শ
জাতিগঠনে এর কোন বিকল্প নেই, আকাঙ্খিত প্রজন্ম নির্মাণে এটাই কাঙ্ক্ষিত
শিক্ষাব্যবস্থা।যার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্যই শুধু নয়, অবশ্যাম্ভীও বটে।একে পরিহার
করে, আল কোরআনের হেদায়েতকে পরিহার করে মুসলমানও থাকা যায়না,সুখেও থাকা অসম্ভব।
আল্লাহপাকের সুস্পষ্ট ঘোষনা, “তোমরা কিতাবের কিছু মানবে আর কিছু মানবেনা, তাহলে
তোমাদের উপযুক্ত পুরস্কার হল পার্থিব লাঞ্ছনা এবং পারলৌকিক জিন্দেগীতে কঠিনতম
শাস্তি”।[5]
আল্লাহপাকের সব নেয়ামতই ধরাপৃষ্ঠে ছড়িয়ে আছে,শুধু
“ইলম” নামক নেয়ামতটি স্বর্গ হতে আল্লাহপাকের নিকট থেকে অবতরন করে।অতএব আল্লাহর
সাথে সম্পর্কহীন যে ইলম সেটা কোন ইলমই নয়।
শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং শৈল্পিক
ও নান্দনিক আধুনিকায়নই যদি হয় শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য, তাহলে বলতে হয় মিশরে
ফেরাউনদের রাজত্বকালেও শিক্ষা ছিলো, বিজ্ঞান ছিলো,শিল্প-নান্দনিকতাও ছিলো;নাহয় মমি
পিরামিড তৈরী হতোনা।প্রাচীন ইরাকে নম্রুদের শাসনকালেও অনেক পুরাকীর্তি গড়ে
উঠেছিলো,ব্যবিলনে স্বামী-স্ত্রীতে বিচ্ছেদ ঘটানোর মতো যাদুবিদ্যার চর্চাও ছিলো।আ’দ
সামুদ জাতি কিংবা অধুনা অংকে কাঁচা প্রমানিত হওয়া ‘মায়ান’ জনগোষ্ঠীও কম উন্নত
ছিলোনা। একেবারে আধুনিককালে নোবেলজয়ী মিখাইল কি পাস্তারনাক বা নভোচারী গ্যাগারিন
কি বিজ্ঞানী সোলঝেনিতসিন দের জন্ম দেয়া সোভিয়েত ইউনিয়নও সমজতান্ত্রিক
শিক্ষাব্যবস্থায় যথেষ্ট উন্নতি সত্তেও মার্কস ও ডারউইনের সবক নিয়ে তৈরী হয়েছিলো
মানবরক্তপিপাসু নাস্তিক্যবাদী লেলিন-স্ট্যালিন।আরো আগে ‘নীটশ’এর শিক্ষা নিয়ে
মানবতাকে কলংকিত করেছিলো হিটলার।এর পরে আসলো অক্সফোর্ড প্রসবকৃত বুশ নামক আধুনিক
আবু জাহেল।আইনস্টাইন আণবিক বোমার মর্মান্তিক ধ্বংসক্ষমতাদৃষ্টে ‘খুবই’ দুঃখ
পেয়েছিলেন সত্যি, কিন্তু এই বোমানির্মাণের জরুরি অনুরোধ রুজভেল্টকে যিনি প্রথম
চিঠি পাঠিয়েছিলেন তিনিই আইনস্টাইন।এরা সবাই শিক্ষিত ছিলেন সন্দেহ নেই, কিন্তু সে শিক্ষা
সুশিক্ষা ছিলোনা-ছিলো কুশিক্ষা।এ জন্যই মহানবী (সঃ) বলেছেন “কুশিক্ষিত ব্যক্তিই
সর্বনিকৃষ্ট”।ইবলিস অনেক উচ্চশিক্ষিত ছিলো বটে,কিন্তু সেটাও ছিলো কুশিক্ষা।তাই উচ্চশিক্ষা
মানেই সুশিক্ষা নয়। তাইতো নবীজি (সঃ) সদাসর্বদা প্রার্থনা করতেন- (اللهم إني أعوذبك من علم لا ينفع)[6]
যে কারনে নমরুদ-ফেরাউনের শিক্ষার
লেনিন-স্ট্যালিনের প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থা বহুমুখী বস্তুবাদী সাফল্য সত্ত্বেও সর্বমানবিক
হাহাকার ও ব্যর্থতাকে ডেকে এনেছে, তেমনি বর্তমান পশ্চিমা-প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থার
জালে অবরুদ্ধ মাছির মতো মানবগোষ্ঠীর সংকট ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে।আর এখানেই
অনিবার্যভাবে নৈতিকতার প্রশ্নটি এসে দাঁড়ায়।
ইসলামের দৃষ্টিতে আত্মাহীণ দেহ একটি
লাশমাত্র এবং দেহহীন আত্মা একটি বিমূরত সত্তা। এর কোন একটিকে উপেক্ষা
করার ভাব্ধারায় যে শিক্ষানীতি রচিত, তা মানবতার জন্যে একবিন্দু কল্যাণও সাধন করতে
পারেনা।তাই ইস্লামের দৃষ্টিতে দেহ ও ইহিকালের যেমন গুরুত্বপূর্ণ,আত্মা ও পরকালও
ততোধিক গুরুত্ববহ। তাইতো ঐহিক ও পারত্রিক শিক্ষার মূল সিলেবাস পবিত্র কোরআন বলছে -
বধির ও জন্মান্ধরা যা-ই বলুক শিক্ষানীতিতে
বাস্তবতামনস্ক জ্ঞানবিজ্ঞানের সাথে প্রগাঢ় নৈতিকতাবোধ ও চেতনা অবিচ্ছেদ্যভাবে
যুক্ত থাকা জরুরী।তাই সাম্প্রদায়িকতা আর মৌলবাদ বলে সরোষে যারা শিক্ষা থেকে ধর্মকে
বাদ দেওয়ার নামে বাস্তবে নৈতিকতাকেই প্রত্যাখ্যান করে তারা মুখে যা-ই বলুক,
অন্ধকার এদের জীবিকা,তমসা এদের অন্তরঙ্গ বন্ধু।শিক্ষাব্যবস্থার সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে
পড়া যে- কঠিন কুষ্ঠরোগ আজ সমগ্র মানবসভ্যতাকে গ্রাস করতে উদ্যত,তার অবসান হোক-এরা
তা চাই না।কারন কোন ডাক্তারই চায় না পৃথিবী থেকে রোগব্যাধি নির্মূল হয়ে যাক,বরং
যেহেতু রোগই তার উপজীবিকা, রোগের ক্রমবিস্তারই তার কাম্য।
কিন্তু যারা জাতির কর্ণধার ও শিক্ষার
নীতি-নির্ধারক তাঁদের ভাবতে হবে তারা অবোধ শিশুও নয়, তৃণভোজী মেষশাবকও নয়।ইসলামী
শিক্ষাব্যবস্থা মানে শুধু নিরংকুশভাবে কোরান-হাদিস চর্চা নয়।এবার দেখা যাক ইসলামী
শিক্ষানীতি আমাদের সামনে কি উন্মোচন করে?
ইসলামী
শিক্ষা-দর্শনের দুটি বিশেষত্ব,(১)সার্বজনীনতা(universality).(২)সত্যানুসন্ধান
(searching for truth)[8]
কারন, ইসলাম মানুষকে শুধু অধিকারের(rights) কথাই শিখায় না,
সেই সঙ্গে তার কর্তব্যের (responsibilities) কথাও বলিষ্ঠভাবে ও বিশেষ গুরুত্ব
সহকারে শিক্ষা দেয়।স্বল্প বাক্যে এ শিক্ষানীতির সিলেবাসকে বিশ্লেষণ করলে যা পাওয়া
যায়-
(ক) ব্যক্তির সম্পর্ক তার স্রষ্টার সঙ্গে, যাকে ঈমান বলে।যেখানে স্রষ্টার
প্রতি তার দায়িত্ব ও কর্তব্য শিক্ষা দেয়া হয়।
(খ) ব্যক্তির সম্পর্ক স্বয়ং তার নিজের সঙ্গে, যাকে নৈতিকতা বলে।যেখানে
ব্যক্তিগত দায়িত্ব ও কর্তব্যের অনুশীলন করা হয়।
(গ) ব্যক্তির সম্পর্ক সমস্ত সৃষ্টিকুলের সঙ্গে, যাকে সামাজিক,রাষ্ট্রীয় ও
আন্তর্জাতিক জীবন প্রনালী বলে।যেখানে তাকওয়া, মনুষ্যত্ব ও মানবিকতার ভিত্তিতে সুষম
সমাজ গঠনের দীক্ষা দেয়া হয়।
(ঘ) শরীয়াতের বিধান তথা ‘আল্লাহর কথা’(Ethical
law) এবং প্রাকৃতিক বিধানত তথা ‘আল্লাহর কাজ’(Natural
law) এর মাঝে সমন্বয় ঘটিয়ে মানবতার কল্যানে ব্যয় করার
জ্ঞান।যেখানে গবেষণা,আবিষ্কারসহ ইতিবাচক ও বিবেকসমর্থিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত
উন্নয়নের রূপরেখা আলোচনা করা করা হয়।
এ সিলেবাসকে শিক্ষার্থীর মনমানসে সঠিক
ও নিপুণভাবে বসানোর পদ্ধতি আমরা নবী মুহাম্মদ সঃ এর জীবনে পর্যায়ক্রমে দেখতে পাই,কারন-
পৃথিবীতে একমাত্র তাঁর চারিত্রিক আদর্শের সনদ দিয়েছেন স্বয়ং মহান রব্বুল আলামীন- (لقد كان لكم في رسول الله أسوة حسنة) [9]
(১)নৈতিকতা, নবীজির জন্মলগ্ন থেকেই তিনি ছিলেন জাহেলী কলুষতা থেকে
সম্পূর্ণ নিরাপদ ও মুক্ত।
(২)পরিবেশ, নবুওত প্রাপ্তির পূর্বলগ্নে আল্লাহর পরিকল্পনামাফিক
তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সামাজিক কুসংস্কার থেকে অনেক দূরে “হেরা”গুহার শিক্ষাবান্ধব
সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে।
(৩)গুরু-শিষ্যের নিঃসঙ্কোচ অবস্থান, অহী প্রেরণের প্রাথমিক পরিস্থিতিতে
নবীজির "ما
أنا بقارء"এর প্রতিক্রিয়ায় জিবরীলের জড়িয়ে ধরে চাপ দেয়ায় নবীজির
ভয়ডর দূর হয়ে যাওয়াটা এরই ইঙ্গিত।
(৪)লক্ষ্য, প্রাথমিক পর্যায়ে নাযিলকৃত “সুরা
মুযযাম্মিল” ও “সূরা মুদ্দাসসির” নবীজির
সম্মুখে উন্মোচন করে দেয় তাঁর নবুওতী জীবনের লক্ষ্য ও চুড়ান্ত উদ্দেশ্য।
(৫)মাধ্যম,সাতটি আঞ্চলিক ভাষায় কোরআন নাযিল হওয়া এবং পরবর্তীতে
প্রশাসনিক কারনে যায়দ (র) কে তাওরাতের ভাষা শিখার নির্দেশ প্রমান করে জ্ঞানার্জন
হতে হবে মাতৃভাষায়,প্রয়োজনে বিদেশী ভাষার জ্ঞানকে নিজ ভাষায় রূপান্তর করতে
হবে।পরবর্তী সময়ের খলিফাদের এ ধরনের পদক্ষেপও এরই প্রমান বহন করে।বর্তমানে
চীন-জাপানও এরই পদাঙ্ক অনুসরন করে চলেছে।
(৬)সমন্বয়, নবী করীম (সঃ) ভিবিন্ন সময়েই সমসাময়িক প্রযুক্তিকে
শিক্ষা ও দাওয়াতের কাজে ব্যবহার করেছেন।দূত মারফত সম্রাটদের নিকট পত্র
প্রদান,খন্দকে সাল্মান ফারসীর (র) কৌশল গ্রহন,জীবনের শেষ যুদ্ধে মিঞ্জানিকের
ব্যবহার,নানাবিধ উপকরনে কোরআন লিপিবদ্ধকরনের নির্দেশ সহ ইত্যাদি প্রযুক্তির
ব্যবহার আমাদের সে কথারই শিক্ষা দেয়।
বর্তমানে অন্তসারসসশুন্য জেনারেল
শিক্ষা ও বাস্তববিবর্জিত মাদ্রসা শিক্ষা উভয়েই ছুটে চলেছে এক অজানা ব্ল্যাক-হোলের
দিকে।এসব স্কুল-কলেজ শিক্ষিতরা উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে শকুনের মতো উরধাকাশে ঘুরে
বেড়াচ্ছে,কিন্তু তাঁদের দৃষ্টি সততই নিম্নমুখী,এই
শকুনের প্রকৃতিদত্ত কাজ হলো মৃত জন্তু জানোয়ারের মাংস ভক্ষন।আর ওদিকে
মাদ্রাসাশিক্ষিতরা মৌমাছির মতো ফুলে ফুলে বিচরন করে মধু আহরন করছে ঠিক,কিন্তু সে
মধু থেকে বঞ্চিত পৃথিবীর বুভুক্ষ মানবতা।বিদ্যার একেকটি টাইটানিক জাহাজ মাল খালাস
করার বন্দরে পৌছতে পারছেনা বা চাইছেন না।
এর
অদ্বৈত ও অনন্য সমাধান হচ্ছে শুধুমাত্র শ্রেণীকক্ষে চর্চিত শিক্ষা (method) নিয়ে
বসে না থেকে সমাজক্ষেত্রে তার তাৎক্ষনিক প্রয়োগ (pactise)
করার প্রচলন করা যা চৌদ্দশ বছর পূর্বেই মানবতার প্রধান শিক্ষক মুহাম্মদ (সঃ) হাতে
কলমে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন।
তাই
আদর্শ জাতিগঠনে প্রচলিত দুইটি শিক্ষাব্যবস্থার পারস্পরিক উপকারিতা বিনিময়,
দুর্বলতা ও ক্ষতিকারক এবং ঝুঁকিপূর্ণ নীতি দূরীকরন, সর্বোপরি সুষম সমাজ গঠনের
তাগিদে নিজেদের মেধা ও অর্জন আদান-প্রদান করে একটি কাঙ্ক্ষিত জাতি গঠনের মাধ্যমে
চলতি দুনিয়ার সর্বস্তরে নিজেদের আসন গেড়ে নেয়া।আমাদের জাতীয় আদর্শ যে ইসলাম,
শিক্ষা সংস্কারের নামে সে কথা অগ্রাহ্য করা মানেই যে লাউ সেই কদু।চলমান ইতিহাসের
পুনরাবৃত্তি।আবহমান বিপরযয় ও অবক্ষয়ের নিরবিচ্ছিন্নতা।
No comments:
Post a Comment